জীবন সর্বদা আশানুরূপ খাতে বয় না। মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। মধ্যপ্রদেশের সিকান্দের বাসিন্দা শিবম সোনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। স্বপ্ন ছিল প্রচুর অর্থ উপার্জন করে দ্রুত বড়লোক হবেন।কিন্তু পরিস্থিতির দুর্বিপাকে সবই হারিয়ে যায় শিবমের।
হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঘর ছাড়েন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে, অন্যের দয়ায় পেট ভরিয়ে আজ তিনিই হয়েছেন অন্নদাতা! মধ্যপ্রদেশে ১০ টাকার আহারের ব্যবস্থা করে শিবম বাঁচিয়ে রেখেছেন শয়ে শয়ে দরিদ্র মানুষকে। আর, হতদরিদ্রদের জন্য রাখেন বিনা পয়সার খাবারও।
অসম্ভবকে সম্ভব করলেন তিনি কেমন করে? আজ জানা যাক সেই কাহিনীই।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভাল লাগত না শিবমের। মাঝপথেই ছেড়ে দেন। টাকা ধার করে রেস্তোরাঁর ব্যবসা শুরু করেন ২৪ বছর বয়সে। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল, হঠাৎ দেখা দিল রোগের ছায়া। সোরিয়াসিস নামে একটি খারাপ চর্মরোগে আক্রান্ত হলেন শিবম। সারা গায়ে লাল লাল ক্ষত, দাদ হাজায় ভরা। সেই অবস্থায় আর খাবারের কাছে যাওয়া যায় না, মানুষ ঘেন্না পাবে। বাড়িতে বসে গেলেন শিবম। ব্যবসা লাটে উঠল কিছুদিনেই।
ধার দেনায় ডুবে বাড়ি ফিরে এলেন শিবম। সকলের চক্ষুশূল হয়ে বাড়ি বসে থাকা অদ্ভুত যন্ত্রণার, শিবম মর্মে মর্মে টের পাচ্ছিলেন। চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলেন ২০২০ নাগাদ। তারপরই এসে গেল করোনা। লোকডাউন ঘোষণা হল দেশ জুড়ে।
এদিকে শিবমের হতাশা তখন এতই তীব্র যে মৃত্যুভয়ের পরোয়া আর ছিল না। লকডাউন ঘোষণার দিন রাতেই তিনি বাড়ি থেকে পালালেন। একটাই বাস যাচ্ছিল তখন ইন্দোর। শেষ বাস, সেটায় উঠে পড়লেন। পকেটে ছিল মোটে ৫০০ টাকা। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বিস্কুট খেয়ে কাটালেন ৩দিন। ৫০০ টাকা শেষ। তারপর?
খুঁজে নিলেন লঙ্গরখানা। লকডাউনের সময় প্যাকেট করা যেসমস্ত খাবার বিলি করা হতো, তাই খেয়েই বেঁচে রইলেন শিবম। রাত কাটালেন প্ল্যাটফর্মে। অনেক খুঁজেও কাজের ব্যবস্থা করতে পারলেন না। খাবারের মর্ম বুঝলেন সেই প্রথম। আর, বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন? সেসব অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে ততদিনে।
অবশেষে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ পেলেন একটা সরকারি হাসপাতালে। বেতন ৬০০০ টাকা। লুফে নিলেন। হাসপাতালের ক্যান্টিনেই খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেল শিবমের। আর চিন্তা নেই। কিন্তু ব্যবসার ধারদেনা যা জমে আছে, তাতে আরও টাকার দরকার। একটা আবাসনেও সিকিউরিটি গার্ডের কাজ নিলেন অন্য খেপে। সেখানে দেবে ৮০০০ টাকা। এবার খাওয়া থাকা দুটোর সমস্যাই দুর হল শিবমের।
একমাস পরে তিনি মা এবং ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। সে রাতে হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়ায় বাড়ির লোক আগেই শিবমের নামে নিখোঁজের ডায়েরি করেছিলেন থানায়। শিবম ফোন করে জানালেন, তিনি ভাল আছেন। কাজ করছেন। আর উপযুক্ত ব্যবস্থা করেই বাড়ি ফিরবেন।
২০২০-র নভেম্বর। শিবমের কাছে বাড়ি থেকে ফোন এল। মা জানালেন, পারিবারিক ধারদেনা চোকাতে না পেরে ভিটেমাটি সব বেচে দিতে হয়েছে এবার। তিনি শিবমকে ফিরে আসতে অনুরোধ করলেন, কিন্তু শিবম ফিরলেন না।কয়েক মাস দুটো জায়গায় কাজ করে ইতিমধ্যে জমিয়ে ফেলেছিলেন ২৫,০০০ টাকা।
সেখান থেকে ধার মিটিয়ে নিলেন কিছুটা। তারপর স্থানীয় এলাকায় জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা দোকানঘর ভাড়া নিলেন ২০,০০০ টাকায়। খাবারের ব্যবসাই করবেন আবার, কিন্তু এবার আর লাভের চিন্তা নয়। খাবার যে মহার্ঘ্য বস্তু, এতকাল রাস্তায় থেকে নিজের জীবন দিয়ে জেনেছেন।
মানুষের মুখের খাবার নিয়ে মুনাফা লোটা অপরাধ!ভাওয়ার কুয়ান স্কোয়ারের মিরা গার্ডেনের কাছে শিবমের নতুন দোকান। নাম দিলেন ‘হাঙ্গার লঙ্গর’। গুরুদ্বারের যে লঙ্গরখানায় খেয়ে শিবম নিজে বেঁচে ছিলেন একসময়, নামের অনুপ্রেরণা এল সেখান থেকেই।
১০ টাকার বিনিময়ে বড়া পাও, মেরু বড়া, বিরিয়ানি এবং মশলা ধোসা মেলে হাঙ্গার লঙ্গরে। নিরামিষ থালি ৩০টাকা। মানুষ তো অবাক! এত সস্তায় এত ভাল খাবার খান ন কেউ। ক্রমশই ভিড় বাড়তে থাকল। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার করে পুরো বিনামূল্যে খাবার। শুভম জানিয়েছেন, “একেবারেই যে লাভ থাকে না তা কিন্তু নয়। ১০ টাকায় বিরিয়ানি কিংবা মশলা ধোসা দিতে লোকসান হয় ঠিকই, আবার ৩০ টাকায় ছোলে বাটোরেতে ১০ টাকা করে লাভ থাকে।” এভাবেই চলে হাঙ্গার লঙ্গর। মাস গেলে ৩০,০০০ টাকা উঠে আসে, তাতেই দোকানের ভাড়া মেটানো যায়।
তাহলে চলে কীভাবে শিবমের? তিনি জানান, অনেক কাজ আছে যা থেকে টাকা রোজগার করা যায়। ইউটিউব চ্যানেল করবেন খুব শিগগির। ভাল রান্নার রেসিপি শেখাবেন তাতে। বিজ্ঞাপনের ব্যবসা করারও পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। তবে, এর সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমাচ্ছেন হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়বেন বলে। খাবার বানানোতেই যে শিবমের আগ্রহ, তা বলে বোঝাতে হয় না।
ইতিমধ্যেই হাঙ্গার লঙ্গরে খদ্দেরের সংখ্যা প্রতিদিন ৫০০ ছাড়িয়েছে। যিনি একবার আসেন, তিনি আসতেই থাকেন। সকলেই খাবারের গুণগত মান এবং মূল্যে যার পর নাই খুশি। মুখে মুখেই ছড়িয়ে গেছে শিবমের দোকানের সুনাম। এলাকার গরীব মানুষরা আজ আর অভুক্ত নন। শিবম তাঁদের খেয়াল রাখেন।
শিবমের মা সম্প্রতি মিডিয়াকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা প্রথমে খুব চিন্তায় ছিলাম। শিবমের ব্যবসাটা যেতেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিল। তারপর ফিরল যখন সে মস্ত বড় মানুষ। আমার খুব গর্ব হয় আজ। আরও বড় লক্ষ্যে ও এগিয়ে যাক, এই কামনা করি।”